ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

নেই প্রযুক্তিগত সুবিধা, মুখ থুবড়ে পড়ছে ঢাবির ই-জোন 

সেন্টার ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের অনীহা

  আরমান হোসেন, ঢাবি

প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২০:১২

নেই প্রযুক্তিগত সুবিধা, মুখ থুবড়ে পড়ছে ঢাবির ই-জোন 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-জোনের বর্তমান অবস্থা। ছবি: প্রতিবেদক

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক করে গড়ে তুলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাইবার সেন্টার। পরে সাইবার সেন্টারটির নামকরণ করা হয় ই-জোন। এক সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ জাগানো এ সেন্টারটি এখন নানা সংকটে ভুগছে। নেই পর্যাপ্ত কম্পিউটার, যেগুলো রয়েছে সেগুলোও বেশ পুরোনো। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। ফলে জৌলুস হারাতে বসেছে এক সময়ের শিক্ষার্থীদের আগ্রহের এই সাইবার সেন্টার।

ই-জোনে কয়েকবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থী শূন্য পড়ে আছে অধিকাংশ কম্পিউটার। মাঝে মাঝে দু'একজন শিক্ষার্থীকে দেখা যায় কম্পিউটার ব্যবহার করছে। দায়িত্বরত কর্মচারীরা জানান, একসাথে দু’একজন শিক্ষার্থীর বেশি উপস্থিতি চোখে পড়ে না। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ই-জোনের সাথে পরিচিত না হওয়ায় এবং আকর্ষণীয় কোনো সুবিধা না থাকায় ই-জোনে যাওয়া হয় না। অন্যদিকে প্রশাসন জানায়, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যাওয়াই এদিকে খুব একটা মনোযোগ দেয়া হয় না।

ই-জোনের সাথে পরিচিত নন শিক্ষার্থীরা

ই-জোনের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনীহার কারণ জানতে চাইলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই জানান, তারা ই-জোনের সাথে পরিচিত নন। প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়ে যাওয়া এবং ই-জোনে আকর্ষণীয় কোনো সুবিধা না থাকাও শিক্ষার্থীদের অনীহার অন্যতম কারণ বলে জানা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ মনসুর বলেন, ই-জোনের কম্পিউটার ব্যবহার শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত তা জানতাম না। শুরু থেকে ভেবে আসছি কম্পিউটারগুলো শুধু শিক্ষক এবং গবেষকদের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে। ফলে কখনো এগুলো ব্যবহারের কথা মাথায় আসেনি।

ঢাবির আরেক শিক্ষার্থী সাকিব হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের এমন একটি সুবিধা আছে তা কখনো শুনিনি। আমাদের যাদের ল্যাপটপ বা কম্পিউটার নেই তাদের জন্য এই সুবিধার কথা আরও আগে জানার দরকার ছিল। একাডেমিক এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদির কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত কম্পিউটার না থাকায় আমরা নানা ভোগান্তির শিকার হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-জোনে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেসব ভোগান্তি দূর করা যাবে।

১৮-১৯ সেশনের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী রাহাত কবির বলেন, ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর এখানে আসার দরকার হয় না। তবুও, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অনেক শিক্ষার্থীরই কম্পিউটার বা ল্যাপটপ নেই। পর্যাপ্ত প্রযুক্তি জ্ঞানও অনেকের নেই বললেই চলে। বিভিন্ন বিভাগে ল্যাব থাকলেও শিক্ষার্থীদের জন্য সবসময় উন্মুক্ত থাকে না। তাই সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তৈরি করতে পারলে ই-জোন শিক্ষার্থীদের কাজে আসবে।

৩০টি কম্পিউটার থেকে অবশিষ্ট আছে মাত্র ৮টি

সাইবার সেন্টারে শুরুতে ৩০টি কম্পিউটার ছিল। এরপর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসে আরও ৩০টি কম্পিউটার। নিন্মমানের বলে দক্ষিণ কোরিয়ার কম্পিউটারগুলো সাইবার সেন্টারে রাখা হয় না।

কম্পিউটার ডিভাইসগুলোতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলে সেগুলো সার্ভিসিংয়ের জন্য বের করে ফেলা হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে এখন ই-জোনে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য আছে মোট ৮টি কম্পিউটার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কম্পিউটারগুলোর বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলে সার্ভিসিংয়ের জন্য বের করা হয়। কিন্তু একবার সার্ভিসিং করার জন্য বের হওয়া ডিভাইস আর এখানে ফিরে আসে না।

প্রযুক্তির অপ্রতুলতার কথা উল্লেখ করে ঢাবি শিক্ষার্থী আলিফ মাহমুদ বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ কম্পিউটার এবং আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে তা সঠিকভাবে প্রচার করলে তারা অবশ্যই সেবা নিতে আসবে।

এবিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল আলম বলেন, কয়েক বছর চলে গেলে কম্পিউটারে সমস্যা দেখা দেয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক না। এখানেও তাই হয়েছে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি না থাকায় নতুন কম্পিউটারেরও আর ব্যবস্থা করা হয়নি।

প্রযুক্তি পুরাতন হওয়াই ব্যবহারে জটিলতা

ই-জোনের তথ্যপ্রযুক্তি শাখায় অবশিষ্ট প্রযুক্তিগুলোর অধিকাংশই পুরাতন হয়ে গেছে। ফলে ব্যবহার করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, পুরাতন হয়ে যাওয়া কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী লতিফ রহমান বলেন, ‘আমি মাঝে মাঝে ই-জোনে কম্পিউটার ব্যবহার করতে আসি। কম্পিউটারের প্রাথমিক দক্ষতাগুলো এখানে এসে অনুশীলন করি। এখানকার পুরাতন ডিভাইসগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হই। এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা উচিত। এছাড়া শুক্র ও শনিবার ই-জোনের তথ্যপ্রযুক্তি শাখা খোলা রাখা উচিত। তাহলে আমরা অবসর সময়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাব।’

ব্যবহারকারী আরেক শিক্ষার্থী জানান, টাইপিং করতে গেলে কিবোর্ডে সমস্যা দেখা দেয়। একেকটা ‘কি’ কয়েকবার চাপ দিতে হয়। এতে দ্রুত টাইপিং করা যায় না। তবে বেশ কিছু ডিভাইস আপডেট, সেগুলোতে সমস্যা হয় না।

সাইবার সেন্টার থেকে ই-জোনে আসার পর থেকে অবনতি

ঢাবির বর্তমান ই-জোনটি সাইবার সেন্টার থেকে ই-জোন হয়েছে ৪ বছর আগে। ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর গ্রন্থাগারের এক বার্ষিক সভায় তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান এটি অনুমোদন দেন।

ই-জোনের অন্তর্ভুক্ত করার পর তথ্যপ্রযুক্তি শাখা নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা জানান সাবেক গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. মো. নাসিরুদ্দিন মুন্সী। তখন তিনি গণমাধ্যমকে জানান, ই-জোনে শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটারের বেসিক ফান্ডামেন্টাল ট্রেনিং, সফটওয়্যার ডেভেলাপমেন্টসহ নানা কোর্স ব্যবস্থা করা হবে।

কিন্তু সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে এখন পর্যন্ত ই-জোনে কোনো কোর্সই চালু হয়নি। এছাড়া ই-জোনে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা জানান,পূর্বে সাইবার সেন্টার থাকাকালীন এর জন্য বার্ষিক ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা বাজেট হতো। ই-জোনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর স্বতন্ত্র বাজেট না থাকায় নতুন কোনো উদ্যোগ আর নেয়া সম্ভব হয়নি।

ই-জোনের তথ্যপ্রযুক্তি শাখার সার্বিক অবস্থা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল আলম বলেন, শুরুতে ইন্টারনেট ব্যবহারের জটিলতা কাটানোর জন্য সাইবার সেন্টার চালু করা হয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন ইন্টারনেট সবার হাতের নাগালে। তাই শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তি শাখায় এসে ইন্টারনেট ব্যবহার করে না।

শিক্ষার্থীদের অবগত না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রতিবছর লাইব্রেরির পক্ষ থেকে প্রতি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ওরিয়েন্টেশন এর ব্যবস্থা করি। ওরিয়েন্টেশনে শিক্ষার্থীদেরকে লাইব্রেরির সুযোগ-সুবিধা জানানো হয়। কোনো বিভাগ যদি ওরিয়েন্টেশনে অংশ না নেয়, তাহলে সেই বিভাগের শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরির সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে না জানাই স্বাভাবিক।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের আইটি দক্ষতা বাড়ানোর দায়িত্ব লাইব্রেরির না। লাইব্রেরির রিসোর্সগুলো ব্যবহারের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ এখানে দেয়া যেতে পারে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি শাখা সেমিনার রুম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একবছরের মধ্যে লাইব্রেরিতে ই-বুক সার্ভিস চালু করা হবে। শিক্ষার্থীরা যেকোনো জায়গায় বসে ই-বুক এক্সেস পাবে। যাদের ই-বুক সুবিধা নিতে সমস্যা হবে তারা তথ্যপ্রযুক্তি শাখায় এসে এই রিসোর্সগুলো ব্যবহার করতে পারবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত